হোমো দিউস: পর্ব ২

মূল: ইউভাল হারারি
অনুবাদ: তাপস

গত পর্বে বলেছিলাম যে বায়োটেকনলজি আর তথ্য বিজ্ঞান আমাদের অকল্পনীয় ক্ষমতা দিতে যাচ্ছে। আর সেই ক্ষমতা দিয়ে আমরা কি করবো? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে একটু পেছনে তাকাতে হবে।

দুনিয়া থেকে কি আসলেই দুর্ভিক্ষ, মহামারী আর যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে? হয়তো অনেকই তেড়েফুড়ে আসবেন এই দাবি শুনলে। আরে ভাই, দুনিয়াদারির কোন খোঁজ খোবর কি রাখেন না? এই যে দুনিয়ায় শতকোটি লোক দিনে ২ ডলারেরও কম আয় করে কোন রকমে বেঁচে আছে সেটা জানেন। বা ধরেন যে আফ্রিকায় এইডস্ এর যে মহামারী সেইটা? হালের করোনা মহামারীর সময় কি নাক কান বন্ধ করে ঘুম দিছেন নাকি? রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ কি চোখে পড়ে না আপনার। আজাইরা আইসা দাবি করতেছে দুর্ভিক্ষ নাই! মহামারী নাই! যুদ্ধ শেষ! পাগল নাকি আপনি?

আসুন দুর্ভিক্ষ দিয়েই শুরু করি। আমাদের হাজার হাজার বছরের এক আতংকের নাম। এই সেদিন পর্যন্ত, বেশিরভাগ মানুষ জৈবিক দারিদ্র্যসীমার একদম প্রান্তে বাস করত। জৈবিক দারিদ্র্যসীমা হচ্ছে খাদ্যের অভাবে এমন এক পর্যায়, যার ফলে অপুষ্টি এবং ক্ষুধার কারণে মারা যাওয়াই নিয়তি। একটি ছোট ভুল বা একটু খারাপ ভাগ্য সহজেই একটি পুরো পরিবার বা গ্রামের জন্য মৃত্যুদণ্ড হতে পারত। যদি ভারী বৃষ্টি আপনার গমের ফসল নষ্ট করে দেয়, বা ডাকাতরা আপনার ছাগলের পাল নিয়ে যায়, তাহলেই হলো। আপনি গুষ্ঠিশুদ্ধ অনাহারে মারা যেতে পারতেন। কিংবা ধরেন সকলে মিলে চাষবাষ সংক্রান্ত কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলেন। অথবা গ্রামের বা সমাজের মুরব্বিরা সবাই মিলে কোন ছাগলামি ডিসিশান গ্রহণ করলেন। ফলাফল হতো ব্যাপক দুর্ভিক্ষ। প্রাচীন মিশর বা মধ্যযুগীয় ভারতে যখন গুরুতর খরা দেখা দিত, তখন জনসংখ্যার ৫ বা ১০ শতাংশ একদম হাওয়া হয়ে যাওয়াটা  অস্বাভাবিক ছিল না। একেতো খাদ্যের যোগান নেই তার উপর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনেকটা বান্দুরা টু ঢাকার গেইটলক সার্ভিসের মতই মন্দার গতির। এইসব কারণে তখনকার প্রশাসকদের জন্য সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়াটা খুবই কষ্টকর ছিল।

আপনি সম্ভবত এমন কোনো ইতিহাস বই পাবেন না যেখানে ক্ষুধার্ত জনগনের ভয়াবহ পরিস্থিতির বিবরণ নেই। এখনকার চকচকে ফ্রান্সের কথাই ধরুন না কেন। মাত্র চারশো বছর আগে তাদের দিকে তাকালে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা দেখতে পেতেন।  সারা ফ্রান্স জুড়ে অসংখ্য লোক ভয়াবহ দরিদ্র জীবন যাপন করছিলো। দুই বেলাতো দূরে থাক, এক বেলা খাবারও জুটতো না তাও দিনের পর দিন। না খেয়ে মারা যাচ্ছিলো অবর্ণনীয় সংখ্যক লোক। ক্ষুধা মেটাতে সেই দরিদ্র মানুষগুলো যা খেত তা শুনলে আপনার বিবমিষা জাগবে। বিড়াল এবং ঘোড়ার চামড়া ছাড়ানো মাংস এবং আবর্জনার ঢিবিতে ফেলে দেওয়া মাংস খুঁজে খুঁজে সেগুলো খাওয়া হতো। অনেকে খাবার হিসাবে খেত গরু ও ষাঁড় জবাই করার সময় যে রক্ত প্রবাহিত হয় এবং যে আবর্জনা রাঁধুনিরা রাস্তায় ফেলে দেয়, সেগুলা। অন্যরা ঘাস আর লতাপাতা পানিতে সিদ্ধ করে জীবন পার করেছে।

পুরো ফ্রান্স জুড়েই এই একই চিত্র দেখা যেত। খারাপ আবহাওয়া তাদের আগের দুই বছরে রাজ্যের ফসল নষ্ট হয়েছিল। তাই ১৬৯৪ সালের বসন্তে খাদ্য গুদামগুলি ছিল সম্পূর্ণ খালি। আর এইরকম অবস্থায় ধনীরা যা করার তাই করেছে। তারা তাদের স্টকের খাবার দাবার আকাশচুম্বী দামে বিক্রি করেছে। ফলাফল: দরিদ্ররা মরেছে দলে দলে। ১৬৯২ এবং ১৬৯৪ সালের মধ্যে প্রায় ২.৮ মিলিয়ন (২৮ লক্ষ) ফরাসি জনগণ, যা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, অনাহারে মারা পড়ে। সেই সময় কিং লুই চতুর্দশ, ভার্সাইয়ে তার উপপত্নীদের সাথে সময় কাটাচ্ছিলেন।

পরের বছর, ১৬৯৫ সালে, দুর্ভিক্ষ এস্তোনিয়ায় আঘাত হানে। জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ মারা যায়। ১৬৯৬ সালে ছিল ফিনল্যান্ডের পালা। যেখানে এক চতুর্থাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। স্কটল্যান্ড ১৬৯৫ থেকে ১৬৯৮ সালের মধ্যে গুরুতর দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিল। কিছু জেলার ২০ শতাংশ পর্যন্ত অধিবাসীরা মারা পড়েছে।

বেশিরভাগ পাঠক সম্ভবত জানেন যখন আপনি দুপুরের কোন কারণে লাঞ্চ মিস করেন তখন কেমন লাগে। বা ধরেন কোনো ধর্মীয় কারণে উপবাস করছেন অথবা ওজন কমানোর জন্য যখন কয়েক দিন শুধু সবজির রস পান করে থাকেন, তখন কতটা “মাজা আয়েগা” লাগে! কিন্তু যখন আপনি দিনের পর দিন কিছু খাননি এবং আর জানেনও না পরের খাবারটি কোথায় পাবেন তখন কেমন লাগবে? আজকের দিনের বেশিরভাগ মানুষ এই অসহনীয় যন্ত্রণা কখনো অনুভব করেনি। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা খুব ভালভাবে এই অনূভুতির সাথে পরিচিত।

গত একশ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের  প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে আমাদের। ফলে আমরা জৈবিক দারিদ্র্যসীমার কবল থেকে মুক্তির জন্য একটি ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী নিরাপত্তা জাল তৈরি করতে পেরেছি।।

গণদুর্ভিক্ষ এখনও কিছু এলাকায় সময়ে সময়ে আঘাত হানে। তবে সেগুলি ব্যতিক্রম। আর প্রায় ক্ষেত্রেই তা ঘটে মানব রাজনীতির কারণে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে না। পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশে, এমনকি কেউ যদি তার চাকরি এবং সমস্ত সম্পত্তি হারায়, তবুও তার ক্ষুধায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ব্যক্তিগত বীমা পরিকল্পনা (পশ্চিমা দেশে), সরকারি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলি তাকে দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার না করতে পারলেও, তারা তাকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দৈনিক ক্যালোরি সরবরাহ করবে।

এখন আমাদের দ্রুত গতির বিশ্বের বাণিজ্য নেটওয়ার্ক এত সমৃদ্ধ যে খরা এবং বন্যাকে হয়ে যায় ব্যবসার সুযোগে। ফলে খাদ্য ঘাটতি দ্রুত এবং সস্তায় কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এমনকি যখন যুদ্ধ, ভূমিকম্প বা সুনামি পুরো দেশকে ধ্বংস করে দেয় তখনও আন্তর্জাতিক চেষ্টায় সাধারণত দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা যায় হয়। যদিও শত শত মিলিয়ন মানুষ প্রায় প্রতিদিন ক্ষুধার্ত থাকে, বেশিরভাগ দেশে খুব কম মানুষ আসলে অনাহারে মারা যায়।

দারিদ্র্যতা অবশ্যই অনেক অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয় আর অপুষ্টি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলিতেও জীবন প্রত্যাশা কমিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সে, ৬ মিলিয়ন মানুষ (প্রায় ১০ শতাংশ জনসংখ্যা) পুষ্টির নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা সকালে উঠে জানে না দুপুরের খাবারের জন্য কিছু পাবে কিনা; তারা প্রায়ই ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়; এবং যে পুষ্টি তারা পায় তা ভারসাম্যহীন এবং অস্বাস্থ্যকর – প্রচুর স্টার্চ, চিনি এবং লবণ, এবং পর্যাপ্ত প্রোটিন এবং ভিটামিনের অভাব। তবুও পুষ্টির নিরাপত্তাহীনতা দুর্ভিক্ষ নয়, এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুর ফ্রান্স ১৬৯৪ সালের ফ্রান্স নয়। এমনকি বুভের বা প্যারিসের আশেপাশের সবচেয়ে খারাপ বস্তিতেও, লোকেরা কয়েক সপ্তাহ ধরে না খেয়ে মারা যায় না।

এরকম উন্নয়ন অন্যান্য অনেক দেশে ঘটেছে। বিশেষ করে চীনে। হাজার হাজার বছর ধরে, হলুদ সম্রাট থেকে লাল কমিউনিস্ট পর্যন্ত প্রতিটি চীনা শাসন ব্যবস্থায় দুর্ভিক্ষ ছিল। কয়েক দশক আগে চীন খাদ্য সংকটের জন্য সুপরিচিত ছিল। ১৯৬০ এর দশকে, তিন কোটি চৈনিক নাগরিক অনাহারে মারা গিয়েছিল। তখন বিশেষজ্ঞরা নিয়মিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতো যে সমস্যা আরও খারাপ হবে। ১৯৭৪ সালে রোমে প্রথম বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের জন্য মহাপ্রলয়-সংক্রান্ত দৃশ্যাবলি তুলে ধরা হয়। তাদের বলা হয়েছিল যে চীনের এক বিলিয়ন মানুষকে খাওয়ানোর কোনো উপায় নেই। আর বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে, হয়েছে উল্টোটি। চীন, ইতিহাসের সবথেকে বড় অর্থনৈতিক খেল দেখানোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭৪ সাল থেকে শত শত মিলিয়ন চীনা দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে। যদিও এখনও আরও শত শত মিলিয়ন চীনা নাগরিক এখনও কঠোর পরিশ্রম এবং অপুষ্টিতে ভুগছে। তবুও তাদের রেকর্ডকৃত ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চীন এখন দুর্ভিক্ষমুক্ত।

প্রকৃতপক্ষে, আজকের বেশিরভাগ দেশে অতিভোজন দুর্ভিক্ষের চেয়ে অনেক খারাপ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনশ্রুতি আছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মেরি অ্যান্টোইনেট অনাহারী জনগণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে যদি তাদের রুটি ফুরিয়ে যায়, তবে তারা কেক খেতে পারে। আজ, দরিদ্ররা এই পরামর্শ হুবহু অনুসরণ করছে। আমেরিকায়  বেভারলি হিলসের ধনী বাসিন্দারা লেটুস সালাদ এবং কুইনোয়ার সাথে স্টিম করা টোফু খান। অন্যদিকে বস্তি এবং ঘেটোতে দরিদ্ররা টুইঙ্কি কেক, চিটোস, হ্যামবার্গার এবং পিজ্জায় ডুবে থাকতে হয়। ২০১৪ সালে ২১০ কোটিরও  বেশি মানুষের অতিরিক্ত ওজনের ছিল। অপরদিকে একই সময়ে তখন ৮৫ কোটি লোক অপুষ্টিতে ভুগছিল। ২০৩০ সালের মধ্যে মানবজাতির অর্ধেক অতিরিক্ত ওজনের হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১০ সালে দুর্ভিক্ষ এবং অপুষ্টির সম্মিলিত কারণে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। অন্যদিকে যেখানে স্থূলতা ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে।

Senzen

Tags:

Comments

Leave a Reply