হোমো দিউস: পর্ব ৩.১

মূল: ইউভাল হারারি
অনুবাদ: তাপস

অদৃশ্য রণবহর

দুর্ভিক্ষের পরে, মানবতার দ্বিতীয় বড় শত্রু ছিল প্লেগ এবং সংক্রামক রোগ। আগের দিনের শহরগুলা এখনকার মত ইন্টারনেটা বা মোবাইল নেটওয়ার্ক দিয়ে যুক্ত ছিল না। বরং অন্যান্য শহর থেকে আগত ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা আর প্রচুর তীর্থযাত্রীদের ক্রমগাত যাতায়ত দিয়ে এগুলো যুক্ত থাকতো। সেই শহরগুলা ছিল আমাদের শহরগুলি মানব সভ্যতার ভিত্তি আর  সেইসাথে রোগজীবাণুর জন্য একটি আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্র।। এর ফলে প্রাচীন এথেন্স বা মধ্যযুগীয় ফ্লোরেন্সের মানুষ তাদের জীবন এমনভাবে কাটাত যে তারা জানত যে তারা পরের সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে মারা যেতে পারে, অথবা হঠাৎ একটি মহামারী দেখা দিয়ে তাদের পুরো পরিবারকে এক ঝটকায় ধ্বংস করে দিতে পারে।

এমন এক মহামারীর শুরটা হয়েছিল আমাদের পূর্ব বা মধ্য এশিয়ায়। ১৩৩০ সালের দিকে। ইতিহাসের বিখ্যাত এই মহামারী ব্ল্যাক ডেথ নামে সুপরিচিত। এক ধরনের নিরিহ পাখাবিহীন ছোট পোকা যাকে আমরা আঠালি নামে ডাকি সেটার মাধ্যমে। ইয়েরসিনিয়া পেসটিস নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যখন সেই আঠালিকে আক্রমণ করে আর সেই আঠালি যখন মানুষকে কামড়ায়, তখন এই প্লেগের শুরু হয়। সেখান থেকে, ইঁদুর এবং এই আঠালি বাহিনীর উপর ভর করে, প্লেগ দ্রুত সারা এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। আর আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে পৌঁছতে কুড়ি বছরেরও কম সময় নেয়। ৭.৫ কোটি থেকে ২০ কোটি মানুষ মারা যায়। ইংল্যান্ডে, প্রতি দশজনের মধ্যে চারজন মারা যায়। প্লেগ এ আগের জনসংখ্যা ছিল ৩.৭ মিলিয়ন। সেটা থেকে প্লেগ পরবর্তী হয় ২.২ মিলিয়ন। ফ্লোরেন্স শহর তার ১ লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে ৫০ হাজারকে হারায়।

তখনকার কর্তৃপক্ষের কোন কিছুই করার ছিল না এই প্লেগর বিষয়ে। সম্পূর্ণভাবে অসহায় ছিল তারা এই বিপর্যয়ের মুখে। এই মহামারীর বিস্তার থামানোর জন্য  গণপ্রার্থনা আর শোভাযাত্রা আয়োজন করা ছাড়া তাদের আর কোন কিছু জানা ছিল না বা করার ছিল না। নিরাময় করা তো দূরের কথা। আধুনিক যুগ পর্যন্ত, মানুষ রোগের জন্য দায়ী করত খারাপ বাতাস, ক্ষতিকারক দানব এবং ক্রুদ্ধ দেবতাদের। তখন মানুষ  ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতোই না। তখন তারা সহজেই দেবদূত ও পরীদের বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা কল্পনাও করতে পারে নাই যে ছোট আঠালি পোকায় কিংবা এক ফোঁটা পানির মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে  প্রাণঘাতী শিকারিদের পুরো একটি বহর।

এই ব্ল্যাক ডেথ কোনো একক বিচ্ছন্ন ঘটনা না। এমনকি ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ মহামারীও নয়। প্রথম ইউরোপীয়দের আগমনের পর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জে আরও বিধ্বংসী মহামারী আঘাত হানে। ভ্রমনকারী আর বসতিস্থাপনকারীরা না জেনে তাদের সাথে নতুন সংক্রামক রোগ নিয়ে আসে। সেইসব রোগের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না। এর ফলে স্থানীয় জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত মারা যায়।

১৫২০ সালের ৫ মার্চ একটি ছোট স্প্যানিশ বহর কিউবা দ্বীপ থেকে মেক্সিকোর পথে যাত্রা করে। জাহাজগুলি ৯০০ স্প্যানিশ সৈন্য, ঘোড়া, আগ্নেয়াস্ত্র এবং কয়েকজন আফ্রিকান ক্রীতদাস বহন করছিল। ক্রীতদাসদের একজন, ফ্রান্সিসকো দে এগুইয়া, তার সাথে আরও মারাত্মক এক জিনিস সাথে করে নিয়ে চলছিল। ফ্রান্সিসকো তা জানত না, কিন্তু তার ট্রিলিয়ন কোষের কোথাও এক কোনে এক জৈবিক টাইম বোমা টিকটিক করে ফাটার অপেক্ষায় বসে ছিল। সেই টাইম বোমাটি হল গুটি বসন্তের ভাইরাস। ফ্রান্সিসকো মেক্সিকোতে অবতরণের পর ভাইরাসটি তার শরীরে দ্রুতগতিতে বংশবিস্তার শুরু করে। তার ত্বকে ভয়াবহ ফুসকুড়ির দেখা দেয়। জ্বরে আক্রান্ত ফ্রান্সিসকোকে সেমপোয়াল্লান শহরের একটি নেটিভ আমেরিকান পরিবারের বাড়িতে শয্যাশায়ী করা হয়। ফ্রান্সিসকো পরিবারটির সকল সদস্যদের সংক্রমিত করেন। সেই সদস্যগণ আবার তাদের প্রতিবেশীদের সংক্রমিত করে। দশ দিনের মধ্যে সেমপোয়াল্লান একটি কবরস্থানে পরিণত হয়। সেমপোয়াল্লানার শরণার্থীরা আবার তাদের কাছাকাছি শহরগুলিতে রোগটি ছড়িয়ে দেয়। একের পর এক শহর মহামারীতে আক্রান্ত হয়। একই সাথে নতুন নতুন আতঙ্কিত শরণার্থীর ঢেউ পুরো মেক্সিকো এবং তার বাইরেও রোগটি ছড়িয়ে দেয়।

ইউকাটান উপদ্বীপের মায়ারা বিশ্বাস করত যে তিনটি দুষ্ট দেবতা – একপেটজ, উজানকাক এবং সোজাকাক – রাতে গ্রাম থেকে গ্রামে উড়ে বেড়াত এবং মানুষকে রোগে সংক্রমিত করত। অ্যাজটেকরা এর জন্য দায়ী করত দেবতা তেজক্যাটলিপোকা এবং জিপেকে অথবা সাদা মানুষদের কালো জাদুকে। পুরোহিত ও ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল। তারা উপদেশ দিয়েছিল প্রার্থনা, ঠান্ডা স্নান, সারা দেহে বিটুমিন লাগানো বা ক্ষতস্থানে কালো গুবড়েপোকা গুড়ো করে সেটা লাগানো। কিছুই কাজ করল না। হাজার হাজার মৃতদেহ রাস্তায় পচে পড়ে থাকত। কেউ এগিয়ে এসে তা দাফন করার সাহস করত না। কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো পরিবার মারা পড়তো। তখন কর্তৃপক্ষ আদেশ দিয়েছিল যে বাড়িগুলো, সেই মৃতদেহের উপরেই ভেঙে ফেলা হোক। কিছু বসতিতে জনসংখ্যার অর্ধেক মারা গিয়েছিল।

১৫২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্লেগ মেক্সিকো উপত্যকায় পৌঁছায়। অক্টোবর মাসে এটি অ্যাজটেক রাজধানী টেনোচটিটলানে পৌছায়। তখন টেনোচটিটলান ছিল  ২৫০,০০০ মানুষের একটি মহানগরী। দুই মাসের মধ্যে অন্তত এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা মারা যায়, যার মধ্যে অ্যাজটেক সম্রাট কুইতলাহুয়াকও ছিলেন। মার্চ ১৫২০ সালে, যখন স্প্যানিশ বহর পৌঁছায়, মেক্সিকোর জনসংখ্যা ছিল ২.২ কোটি, কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যে মাত্র ১.৪ কোটি মানুষ জীবিত ছিল।

গুটি বসন্ত ছিল কেবল প্রথম আঘাত। যখন নতুন স্প্যানিশ প্রভুরা নিজেদের সমৃদ্ধ করা এবং স্থানীয়দের শোষণে ব্যস্ত ছিল, তখন ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের মারাত্মক ঢেউ একের পর এক মেক্সিকোতে আঘাত হানে। ফলাফল, ১৫৮০ সালে এর জনসংখ্যা ২০ লক্ষের নিচে নেমে আসে।

দুই শতক পর, ১৭৭৮ সালের ১৮ জানুয়ারি, ব্রিটিশ আবিষ্কারক ক্যাপ্টেন জেমস কুক হাওয়াইতে পৌঁছান। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে তখন পাঁচ লাখ মানুষের ঘনবসতি ছিল। হাওয়াইবাসীরা  ইউরোপ এবং আমেরিকা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাস করত। তাই তারা ইউরোপীয় এবং আমেরিকান রোগের সংস্পর্শে কখনো আসেনি। ক্যাপ্টেন কুক এবং তার সঙ্গীরা হাওয়াইতে প্রথমবারের মতো ফ্লু, যক্ষ্মা এবং উপদংশ রোগজীবাণু নিয়ে আসেন। পরবর্তী ইউরোপীয় দর্শকরা টাইফয়েড এবং গুটি বসন্ত যোগ করেন। ১৮৫৩ সালের মধ্যে হাওয়াইতে মাত্র ৭০,০০০ জীবিত ব্যক্তি অবশিষ্ট ছিল।

মহামারীগুলি বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে থাকে। ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে উত্তর ফ্রান্সের খন্দকের সৈন্যরা একটি বিশেষভাবে মারাত্মক ফ্লু প্রজাতির কারণে হাজারে হাজারে মারা যেতে থাকে। একে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে ডাকা হত। সেই যুদ্ধের সন্মুখভাগটি  ছিল তত্কালীন পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকরী বৈশ্বিক সরবরাহ নেটওয়ার্কের প্রান্ত। ব্রিটেন, ইউএসএ, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আসত সৈন্য আর অস্ত্রশস্ত্র, মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল, আর্জেন্টিনা থেকে শস্য এবং গরুর মাংস। মালয় থেকে রাবার আর কঙ্গো থেকে তামা পাঠানো হচ্ছিল। বিনিময়ে, তারা সকলেই স্প্যানিশ ফ্লু পায়।

কয়েক মাসের মধ্যে, প্রায় অর্ধ বিলিয়ন মানুষ – বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ – এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। ভারতে এটি জনসংখ্যার ৫ শতাংশ (১৫ মিলিয়ন মানুষ) হত্যা করে। তাহিতি দ্বীপে ১৪ শতাংশ মানুষ মারা যায়। সামোয়াতে ২০ শতাংশ। কঙ্গোর তামার খনিতে প্রতি পাঁচজন শ্রমিকের একজন মারা যায়। সব মিলিয়ে, মহামারীটি এক বছরেরও কম সময়ে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। তুলনা করার জন্য বলা যেতে পারে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে ৪০ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করে।

এইসব মহা-মহামারীতো ছিলোই, এগুলো ছাড়াও আরও অনেক ছোট ছোট কিন্তু নিয়মত সংক্রামক রোগে প্রতি বছর মারা পড়তো লক্ষ লক্ষ মানুষ। শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এমনেতেই কম, তাই তাদের উপর এই সকল সংক্রামক রোগের কোপটা বেশী পড়তো। সেই কারণেই এগুলাকে ‘শিশু রোগ’ বলা হতো। বিশ শতকের প্রথম দিকে পর্যন্ত, অপুষ্টি এবং রোগের আক্রমণে প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মারা যেত।

গত শতাব্দীতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আর উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কারণে এই মহামারীগুলা আমাদের জন্য আরও ভয়াবহ হয় উঠে। এখনকার টোকিও বা কিনশাসার মতো একটি আধুনিক মহানগরী, মধ্যযুগীয় ফ্লোরেন্স বা ১৫২০ সালের টেনোচটিটলানের চেয়ে অনেক বেশি আদর্শ, জীবাণু সংক্রমণের জন্য। বৈশ্বিক পরিবহন নেটওয়ার্ক, ১৯১৮ সালের থেকে আজ আরও বেশি কার্যকর। একটি স্প্যানিশ ভাইরাস ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে কঙ্গো বা তাহিতিতে পৌঁছাতে পারে। এদিক দিয়ে ভাবলে, আমাদেরতো মহামারীর নরকে বাস করার কথা ছিল, যেখানে একের পর এক প্রাণঘাতী প্লেগ আঘাত হানার কথা।

কিন্তু গত কয়েক দশকে মহামারীর ঘটনার হার এবং প্রভাব উভয়ই নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশেষত, বৈশ্বিক শিশু মৃত্যুর হার সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই ৫ শতাংশরও কম শিশু মারা যায়। উন্নত বিশ্বে এই হার ১ শতাংশেরও কম। এই অলৌকিক ঘটনাটি বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অর্জনের ফল। এই উন্নত চিকিৎসাবিদ্যা আমাদেরকে দিয়েছে টিকা, অ্যান্টিবায়োটিক, উন্নত স্বাস্থ্যবিধি আর অনেক ভালো চিকিৎসা অবকাঠামো।

উদাহরণস্বরূপ, গুটি বসন্তের টিকাদানের বৈশ্বিক অভিযান এতটাই সফল হয়েছিল যে, ১৯৭৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করে যে মানবজাতির বিজয় অর্জন করেছে এই রোগের বিরুদ্ধে আর গুটি বসন্তকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা গেছে। এটিই প্রথম মহামারী যা আমরা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে গুটি বসন্ত তখনও ১৫ মিলিয়ন মানুষকে সংক্রামিত করেছিল এবং এর মধ্যে ২ মিলিয়নকে হত্যা করেছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে একটি মানুষও গুটি বসন্ত দ্বারা সংক্রামিত বা নিহত হয়নি। বিজয় এতটাই সুসম্পূর্ণ হয়েছে যে আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মানুষের বিরুদ্ধে গুটি বসন্তের টিকাদান বন্ধ করে দিয়েছে।

প্রতি কয়েক বছর পরপর আমরা সম্ভাব্য নতুন কোনো মহামারীর প্রাদুর্ভাব নিয়ে আতঙ্কিত হই। যেমন ২০০২/৩ সালে SARS, ২০০৫ সালে বার্ড ফ্লু, ২০০৯/১০ সালে সোয়াইন ফ্লু এবং ২০১৪ সালে ইবোলা। তবে দক্ষ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কারণে এই ঘটনা সমূহ তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক লোক মারা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, SARS প্রাথমিকভাবে নতুন ব্ল্যাক ডেথের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১,০০০ জনেরও কম মানুষের মৃত্যু এর দিয়ে এর শেষ হয়। পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার প্রাদুর্ভাব প্রথমে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে মনে হয়েছিল। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে আধুনিককালের সবচেয়ে গুরুতর জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা হিসাবে বর্ণনা করেছিল। তবে, ২০১৫ সালের শুরুর দিকে মহামারীটি নিয়ন্ত্রণে আসে, এবং ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে শেষ ঘোষণা করে। এই ইবোলা ভাইরাস, ৩০,০০০ মানুষকে সংক্রামিত করেছিল (যার মধ্যে ১১,০০০ জনকে হত্যা করেছিল), পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছিল এবং বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের  ঢেউ লেগেছিল। কিন্তু এটি পশ্চিম আফ্রিকার বাইরে ছড়ায়নি, আর এর মৃত্যু হার স্প্যানিশ ফ্লু বা মেক্সিকোর গুটি বসন্ত মহামারীর মতো বড় আকারের ছিল না।

এমনকি এইডসের ট্র্যাজেডি, যা গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা ব্যর্থতা বলে মনে হয়, তাও অগ্রগতির একটি নিদর্শন হিসাবে দেখা যেতে পারে। ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকের বড় আকারের প্রাদুর্ভাব থেকে, ৩০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এইডসে মারা গেছে, এবং আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নতুন মহামারীটিকে বোঝা এবং চিকিৎসা করা কঠিন ছিল, কারণ এইডস একটি ধূর্ত রোগ। যেখানে গুটি বসন্তে আক্রান্ত একজন মানুষ কয়েক দিনের মধ্যে মারা যায়, একটি এইচআইভি-পজিটিভ রোগী কয়েক সপ্তাহ বা মাসের জন্য সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হতে পারে। আর অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্যদের সংক্রমিত করে যেতে পারে। এছাড়াও, এইচআইভি ভাইরাস নিজে মারে না। বরং, এটি প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে, ফলে রোগীকে অসংখ্য অন্যান্য রোগের সম্মুখীন করে। এই গৌণ রোগগুলোই প্রকৃতপক্ষে এইডসের শিকারদের মেরে ফেলে। এর ফলে, যখন এইডস ছড়াতে শুরু করে, তখন কী ঘটছে তা বোঝা বিশেষভাবে কঠিন ছিল। যখন ১৯৮১ সালে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে দুইজন রোগী ভর্তি হয়েছিল, একজন নিউমোনিয়ায় এবং অন্যজন ক্যান্সারে মারা যাচ্ছিল। তখন একেবারেই বোঝা সম্ভব ছিল না যে উভয়েই আসলে এইচআইভি ভাইরাসের শিকার। সেই এইডস্ সম্ভবত কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক বছর আগে তাদের সংক্রমিত করেছিল।

তবে, এই সব সমস্যা সত্ত্বেও, চিকিৎসা সম্প্রদায় যখন রহস্যময় নতুন প্লেগ (এইডস্) সম্পর্কে সচেতন হয়, তখন বিজ্ঞানীদের মাত্র দুই বছর সময় লাগে এটিকে শনাক্ত করতে, ভাইরাসটি কীভাবে ছড়ায় তা বোঝার জন্য এবং মহামারীটি ধীর করার কার্যকর উপায় প্রস্তাব করতে। আর দশ বছরের মধ্যেই নতুন ওষুধগুলি এইডসকে মৃত্যু দণ্ড থেকে একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থায় পরিণত করে (অন্তত ধনীদে জন্য)। শুধু ভাবুন, যদি ১৫৮১ সালে এইডসের প্রাদুর্ভাব ঘটে, ১৯৮১ সালের পরিবর্তে, তাহলে কী হত। কোনভাবেই সেই সময়ে কেউই মহামারীর কারণ, এটি কীভাবে একজন থেকে অন্যজনের কাছে ছড়ায়, বা কীভাবে এটি থামানো যেতে পারে (চিকিৎসা তো দূরের কথা) তা বুঝতে পারত না। এমন অবস্থায়, এইডস মানবজাতির একটি বড় অংশকে হত্যা করতে পারত। হয়তো ব্ল্যাক ডেথের মৃত্যু হারকেও অতিক্রমও করে যেতে পারত।

এইডসের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি এবং ম্যালেরিয়া মতো দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাওয়া সত্ত্বেও, আজকের দিনে মহামারীগুলি পূর্ববর্তী সহস্রাব্দের তুলনায় মানব স্বাস্থ্যের জন্য অনেক কম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ আজকাল সংক্রামক ব্যাধি নয়, বরং ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মতো অসংক্রামক রোগে মারা যায়। কিংবা শুধু বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যায়। (লক্ষণীয় ব্যাপার যে, ক্যান্সার এবং হৃদরোগ অবশ্যই নতুন রোগ নয়। এইগুলা প্রাচীনকাল থেকেই। তবে  আগের যুগগুলাতে অল্প সংখ্যক লোকজনই দীর্ঘ জীবন লাভ করতো। তাই ক্যান্সার বা হৃদরোগে মারা পড়তোও কম)

অনেকের আশঙ্কা যে এটি কেবল একটি সাময়িক বিজয়, এবং ব্ল্যাক ডেথের কোনো অজানা জ্ঞাতিভাই কাছেই অপেক্ষা করছে। কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে না যে প্লেগ ফিরে আসবে না। কিন্তু ডাক্তার এবং জীবাণুর মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ডাক্তারাই এগিয়ে আছে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। নতুন সংক্রামক রোগের আবির্ভাব ঘটে মূলত বিবর্তনের ফলে। অর্থাৎ কোন কারণে তাদের জিনে কোন অপ্রত্যাশিত কোন পরিবর্তন ঘটার ফলে (এটাকে সংক্ষেপে মিউটেশান বলে) তারা সুপার পাওয়ার পেয়ে যায়। আগে হয়তো তারা শুধু হয়তো পাখিকে আক্রমণ করতে পারতো । এখন এই সুপার পাওয়ারের ফলে তারা পাখিতো পাখি, এমনকি মানুষকেও আক্রমণ করতে সক্ষম হয়। কিংবা ধরেন এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে পারে। এখনকার সময়ে এই ধরনের মিউটেশানের ঘটনা আরও বেশি করে ঘটছে। কারণ আর কিছুই না, আমরা মানুষেরা আজকাল প্রকৃতির উপর আগে থেকে অনেক বেশী খবরদারী শুরু  করেছি তাই। তারপরেও, এখনকার রোগবালাইরা ঔষধের বিরুদ্ধে দৌড় প্রতিযোগিতায় বেশ বেকায়দায় আছে। কারণ শেষ পর্যন্ত এই জীবাণুদের অন্ধ্য ভাগ্যের হাতেই নির্ভর করতে হয়।

বিপরীতে, ডাক্তাররা কেবল সৌভাগ্যের উপর নির্ভর করেন না। যদিও সৌভাগ্যের কাছে বিজ্ঞান বিশাল ঋণী, তারপরেও ডাক্তাররা কেবলমাত্র বিভিন্ন রাসায়নিককে টেস্ট টিউবগুলিতে ফেলে দিয়ে বসে থাকেন না বা  কিছু নতুন ওষুধ পাওয়ার আশা করেন না। প্রতিটি বছর পার হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তাররা আরও ভাল এবং উৎকৃষ্ট জ্ঞান অর্জন করে, যা তারা আরও কার্যকর ওষুধ এবং চিকিৎসা ডিজাইন করার জন্য ব্যবহার করে। সুতরাং, যদিও ২০৫০ সালে আমরা নিঃসন্দেহে আরও ভয়ংকর জীবাণুর মুখোমুখি হব, ২০৫০ সালের ওষুধ সম্ভবত তাদের আরও দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে আজকের তুলনায়।

২০১৫ সালে ডাক্তাররা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার ঘোষণা করেন – টেইক্সোব্যাকটিন – যার প্রতি ব্যাকটেরিয়ার এখনও কোনো প্রতিরোধ নেই। কিছু পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে টেইক্সোব্যাকটিন উচ্চ প্রতিরোধী জীবাণুগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এছাড়াও বিপ্লবী নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি করছেন যা আগের যেকোনো ওষুধের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু গবেষণাগার ইতিমধ্যে ন্যানো-রোবট নিয়ে গবেষণা করছে। এই ন্যানো রোবটরা একদিন আমাদের রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে চলাফেরা করে, রোগ নির্ণয় করতে আর জীবাণু ও ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে পারবে। ক্ষুদ্র জীবাণুগুলির ৪০০ কোটি বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে জৈবিক শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার। কিন্তু এই ন্যানো রোবটদের বিরুদ্ধে তাদের অভিজ্ঞতা শূন্য, ফলে তাদের কার্যকর প্রতিরক্ষা বিকাশ করা তাদের জন্য দ্বিগুণ কঠিন হবে।

তাই আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে নতুন কোনো ইবোলা প্রাদুর্ভাব বা অজানা ফ্লু স্ট্রেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে না এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করবে না। কিন্তু এখন আমরা এটিকে অবশ্যম্ভাবী প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে দেখব না। বরং, আমরা এটিকে একটি অমার্জনীয় মানব ব্যর্থতা হিসেবে দেখব এবং দায়ীদের বিচার দাবি করব। যখন ২০১৪ সালের গ্রীষ্মের শেষে কয়েকটি ভয়ঙ্কর সপ্তাহের জন্য মনে হয়েছিল যে ইবোলা, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের উপর আধিপত্য বিস্তার করছে, তখন করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ১৮ অক্টোবর ২০১৪তে প্রকাশিত একটি প্রাথমিক প্রতিবেদনে প্রাদুর্ভাবের প্রতি অসন্তোষজনক প্রতিক্রিয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমালোচনা করা হয়, এবং মহামারীটির জন্য ডব্লিউএইচও-র আফ্রিকান শাখার দুর্নীতি এবং অদক্ষতাকে দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও দ্রুত এবং যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া না দেওয়ার জন্য আরও সমালোচনা করা হয়। এই সমালোচনা ধরে নেয় যে মানবজাতির মহামারী প্রতিরোধের জ্ঞান এবং সরঞ্জাম রয়েছে, এবং তারপরেও যদি কোন মহামারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে এটি মানব অদক্ষতার কারণেই, ঈশ্বরের ক্রোধের কারণে নয়।

তাই এইডস এবং ইবোলার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, পাল্লা মানবজাতির পক্ষে ঝুঁকছে। কিন্তু মানব প্রকৃতির মধ্যেই থাকা বিপদগুলোর কী হবে? জৈবপ্রযুক্তি আমাদের ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস পরাজিত করতে সক্ষম করবে। কিন্তু এটি একই সাথে মানুষকেও এক অভূতপূর্ব হুমকিতে পরিণত করবে। একই প্রযুক্তিগুলা যা ডাক্তারদের দ্রুত নতুন অসুস্থতা সনাক্ত করতে এবং নিরাময় করতে সক্ষম করে, সেগুলিই সৈন্য এবং সন্ত্রাসীদের আরও ভয়ঙ্কর রোগ এবং ধ্বংসাত্মক জীবাণু অস্ত্র তৈরি করতেও সক্ষম করতে পারে। তাই সম্ভবত ভবিষ্যতে প্রধান মহামারীগুলি মানবজাতির জন্য বিপদ হিসাবে রয়ে যাবে কেবল তখনই যদি মানবজাতি নিজেই সেগুলি সৃষ্টি করে, কোন নিষ্ঠুর মতাদর্শের সেবায়। যে যুগে মানবজাতি প্রাকৃতিক মহামারীর সামনে অসহায় ছিল সম্ভবত তা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা হয়তো সেই যুগকে মিস করবো।

Tags:

Comments

Leave a Reply