হোমো দিউস: পর্ব ৩.২

মূল: ইউভাল হারারি
অনুবাদ: তাপস

তাহলে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে কী বলা যায়? এমনকি যদি কেন্দ্রীয় সরকার এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি সংযম শিখে থাকে, সন্ত্রাসীদের নতুন এবং ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। এটি অবশ্যই একটি উদ্বেগজনক সম্ভাবনা। তবে, সন্ত্রাসবাদ হলো দুর্বলতার কৌশল যা বাস্তব ক্ষমতার অভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিদের দ্বারা গৃহীত হয়। অন্তত অতীতে, সন্ত্রাসবাদ বাস্তবিক ক্ষতি না করে ভীতি ছড়িয়ে কাজ করত। সন্ত্রাসীদের সাধারণত একটি সেনাবাহিনী পরাজিত করার, একটি দেশ দখল করার বা সম্পূর্ণ শহর ধ্বংস করার ক্ষমতা থাকে না। ২০১০ সালে স্থূলতা এবং সম্পর্কিত অসুস্থতাগুলি প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিল, সন্ত্রাসীরা সারা বিশ্বে মোট ৭,৬৯৭ জন মানুষকে হত্যা করেছিল, যাদের বেশিরভাগই উন্নয়নশীল দেশে ছিল। একটি সাধারণ আমেরিকান বা ইউরোপিয়ানের জন্য, কোকা-কোলা আল-কায়েদার চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক হুমকি।

তাহলে, কিভাবে সন্ত্রাসীরা শিরোনামগুলি দখল করতে এবং সারা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়? তাদের শত্রুদের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্ররোচিত করার মাধ্যমে। মূলত, সন্ত্রাসবাদ একটি শো। সন্ত্রাসীরা ভয়াবহ সহিংসতার একটি প্রদর্শনী মঞ্চস্থ করে যা আমাদের কল্পনাকে আকর্ষণ করে এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা মধ্যযুগীয় বিশৃঙ্খলার দিকে ফিরে যাচ্ছি। ফলে, রাষ্ট্রগুলি প্রায়ই সন্ত্রাসবাদের নাটকের প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি নিরাপত্তা প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়, প্রচণ্ড শক্তি প্রদর্শন করে যেমন পুরো জনগণের উপর অত্যাচার বা বিদেশী দেশ আক্রমণ করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, সন্ত্রাসবাদের এই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া আমাদের নিরাপত্তার জন্য সন্ত্রাসীদের চেয়েও বড় হুমকি সৃষ্টি করে।

সন্ত্রাসীরা হলো এমন একটি মাছি যা একটি চায়না দোকান ধ্বংস করার চেষ্টা করে। মাছিটি এতটাই দুর্বল যে এটি একটি চায়ের কাপও সরাতে পারে না। তাই এটি একটি ষাঁড় খুঁজে পায়, তার কানে ঢুকে গুঞ্জন করতে থাকে। ষাঁড়টি ভয় এবং ক্রোধে পাগল হয়ে যায় এবং চায়না দোকানটি ধ্বংস করে। গত দশকে মধ্যপ্রাচ্যে এমনটাই ঘটেছে। ইসলামী মৌলবাদীরা নিজেরাই কখনোই সাদ্দাম হুসেইনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারত না। পরিবর্তে তারা ৯/১১ হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রুদ্ধ করেছিল, এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের চায়না দোকান ধ্বংস করেছিল। এখন তারা সেই ধ্বংসাবশেষে সমৃদ্ধি লাভ করছে। সন্ত্রাসীরা নিজেরাই আমাদের মধ্যযুগে ফিরিয়ে এবং জঙ্গল আইন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে খুবই দুর্বল। তারা আমাদের প্ররোচিত করতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। যদি জঙ্গল আইন আবার কার্যকর হয়, এটি সন্ত্রাসীদের দোষ হবে না।

আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে আজকাল রাস্ট্রগুলো আর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে তা এড়াতে। অবশ্যই নিজেদের লাভের জন্যই। কিন্তু আরেকটি পক্ষ আছে যাদের উদ্দ্যেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের চেষ্টাই থাকে কিভাবে একটি যুদ্ধ বা সংঘাত তৈরি করা যায়। ঠিকই ধরেছেন। সেই গোষ্ঠীদের আমরা চিনি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হিসাবে। আর তাদের মতবাদ পরিচিত সন্ত্রাসবাদ হিসাবে।

আমাদের সময়ে এই সন্ত্রাসবাদ অবশ্যই উদ্বেগজনক এক সম্ভাবনা। তবে আশার কথা হল এই   সন্ত্রাসবাদ আসলে দুর্বল গোষ্ঠীদের কৌশল, যাদের বাস্তব ক্ষমতার অভাব রয়েছে এমনসব ব্যক্তিদের দ্বারা সংগঠিত। অন্তত অতীতে, সন্ত্রাসবাদ বাস্তবিক ক্ষতি না করে ভীতি ছড়িয়ে কাজ করত। সন্ত্রাসীদের সাধারণত একটি সেনাবাহিনী পরাজিত করার, একটি দেশ দখল করার বা সম্পূর্ণ শহর ধ্বংস করার ক্ষমতা থাকে না। ২০১০ সালে অতিরিক্ত ওজন এবং এর সংক্রান্ত অসুস্থতায় প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মরা গেছে। অপরদিকে, সন্ত্রাসীদের  হাতে সারা বিশ্বে মারা পড়েছে মোট ৭,৬৯৭ জন মানুষ। হতাহতদের বেশিরভাগই দরিদ্র দেশের। একজন সাধারণ আমেরিকান বা ইউরোপিয়ানের জন্য, কোকা-কোলা, আল-কায়েদার চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক হুমকি।

এই সন্ত্রাসীদের কাজকর্ম যদি এতই নগন্য হয় তাহলে তারা কিভাবে আমাদের মিডিয়াগুলার শিরোনাম জুড়ে রাজত্ব করে আর সারা বিশ্বের রাজনীতির হালচাল বদলে দেয়?

ভাল প্রশ্ন। সন্ত্রাসীরা ওপরের সেই কাজগুলা করতে পারে তাদের শত্রুদের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্ররোচিত করার মাধ্যমে। অর্থাৎ আমাদের যতটকু প্রতিক্রিয়া দেখানো দেখানো দরকার, তারথেকে অনেকগুণ বেশি রিএকশান প্রদর্শন করি। অনেকটা মশা মারতে কামান দাগার মত। মশা হয়ত মরে, কিন্তু সাথে আরও অনেক প্রাণী আর ঘরবাড়িও ধ্বংশপ্রাপ্ত হয়।

আসলে, সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে একটি নাটক। সন্ত্রাসীরা ভয়াবহ সহিংসতার একটি প্রদর্শনী মঞ্চস্থ করে যা আমাদের কল্পনাকে আকর্ষণ করে এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা মধ্যযুগীয় বিশৃঙ্খলার দিকে ফিরে যাচ্ছি। ফলে, রাষ্ট্রগুলি প্রায়ই সন্ত্রাসবাদের নাটকের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরেকটি নিরাপত্তার মহড়া দেখাতে বাধ্য হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রচণ্ড শক্তি প্রদর্শন করে। যেমন পুরো জনগণের উপর অত্যাচার বা বিদেশী দেশ আক্রমণ করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, সন্ত্রাসবাদের এই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া আমাদের নিরাপত্তার জন্য সন্ত্রাসীদের চেয়েও বড় হুমকি সৃষ্টি করে। যেমন ধরুন আপনার এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার জন্য আপনার গ্রামের সকল যুবকদের ধরে নিয়ে থানায় পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা হল। তারপর সেই যুবকদের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা দিয়ে জেলের ঘানি টানানো হলো বছর খানেকের। এখন চিন্তা করুন বিনা অপরাধে জেল খাটা, মার খাওয়া সেই যুবকরা কি তাদের সরকারের প্রসংশায় পঞ্চমুখ থাকবে? নাকি তাদের আপনি সরকার বিরোধি কার্যক্রমে আবিষ্কার করবেন?

সন্ত্রাসীরা হলো ফাজিল মাছির মত। যাদের টার্গেট হলো একটি সুন্দর সাজানো গোছানো চিনামাটির তৈজসপত্রের দোকান ভাঙ্গা। কিন্তু মাছিটি এতটাই দুর্বল যে এটি একটি চায়ের কাপও নড়ানোর ক্ষমতা তার নেই। তাই এই মাছিটি তখন একটি ষাঁড় খুঁজে বেড়ায়। তারপর সে সেই ষাঁড়টির কানে ঢুকে গুঞ্জন করতে থাকে। ষাঁড়টি ভয় এবং ক্রোধে পাগল হয়ে যায় এবং চায়না দোকানটি ধ্বংস করে। গত দশকে মধ্যপ্রাচ্যে এমনটাই ঘটেছে। ইসলামী মৌলবাদীরা নিজেরাই কখনোই সাদ্দাম হুসেইনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারত না। পরিবর্তে তারা ৯/১১ হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল, এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের চায়না দোকান ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন  সন্ত্রাসবাদীরা সেই ধ্বংসাবশেষে সমৃদ্ধি লাভ করছে।

আমাদের মধ্যযুগে ফিরিয়ে এবং সেই জঙ্গলা আইন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য যে ক্ষমতা দরকার তার খুব অল্পই আছে সন্ত্রাসীদের। তারা আমাদের উস্কানি দিতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি উপর নির্ভর করে আমরা কতটুকু প্রতিক্রিয়া দেখাই তার উপর। যদি জঙ্গল আইন আবার কার্যকর হয়, এটি সন্ত্রাসীদের দোষ হবে না।

Tags:

Comments

Leave a Reply