হোমো দিউস: পর্ব ৪.২

মূল: ইউভাল হারারি
অনুবাদ: তাপস

আগামী দশকগুলোতে দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং যুদ্ধে সম্ভবত আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে। ভাই আপনি যে আগের পর্বগুলাতে বললেন যে এগুলা আমরা জয় করেছি? তাহলে নিজের কথা নিজেই ভুল বলছেন?

আসলে তা না। একটু ব্যাখ্যা করি। আগামী দশকগুলোতে দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং যুদ্ধে সম্ভবত আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে ঠিকই কিন্তু সেটার সাথে আগের দিনগুলার একটি বড় পার্থক্য থাকবে। আগের সময়ের মত এগুলা ছিল আমাদের ব্যাখ্যাতীত এবং একদম নিয়ন্ত্রনের বাইরে ঘটা দু:খজনক ঘটনা। কিন্তু এ শতকে সেই একই সমস্যাগুলা আছে ঠিকই কিন্তু আমরা সেগুলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

তারমানে এই না যে যেহেতু এই দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং যুদ্ধ এগুলা আমরা চাইলে বাদ দিতে পারি তাই এ সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা বন্ধ করা উচিত। বরং এর উল্টোটা সত্য।

আমাদের পুরো ইতিহাস জুড়ে আমরা মেনে নিয়েছিলাম যে এই সমস্যাগুলার কোন সমাধান নেই। আর তাই এগুলোর অবসান ঘটানোর চেষ্টা করার কোন অর্থও ছিল না। আমরা মানুষেরা ঈশ্বরের কাছে অলৌকিক ঘটনার জন্য প্রার্থনা করতাম, কিন্তু নিজেরা এই দুর্ভিক্ষ, মহামারি আর যুদ্ধ বিলোপ করার চেষ্টা করিনি কখনও।

অনেকেই যুক্তি দেন যে আমাদের এই ২০২৪ সালের পৃথিবী সেই ১৯২৪ সালের মতোই আছে। সেই সময়ের মতই চারিদিকের মানুষজন ক্ষুধার্ত, অসুস্থ এবং সহিংস জীবন যাপন করছে। এই যু্ক্তিকে আমরা সেই প্রাচীন পরাজয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিবলতে পারি। কারণ এরা বোঝাতে চান যে এই বিশ শতকে আমদের অর্জন শূন্য। চিকিৎসা গবেষণা, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং শান্তি উদ্যোগ সবই ব্যর্থ হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে আরও চিকিৎসা গবেষণায়, নতুন অর্থনৈতিক সংস্কারে বা নতুন শান্তি উদ্যোগে আমাদের সময় এবং সম্পদ বিনিয়োগ করে লাভটা কি?

আমরা যদি আমাদের অতীতের সাফল্যগুলির স্বীকার করি তাহলে একটি লাভ আছে। আমাদের সেই সাফল্যের স্বীকৃতির মাধ্যম্যে আমরা আরও বড় কিছু অর্জনের চেষ্টা করতে উৎসাহ পাই। তাই বিশ শতকের অর্জনগুলিকে যদি আপনি হিসাবে নেন, তাহলে এই যে মানুষের দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং যুদ্ধের কারণে ভুগতে থাকাটা, তখন সেটিকে আর প্রকৃতি বা ঈশ্বরের উপর দোষ দিয়ে দায় সারতে পারবেন না। তখন আপনি জানেন যে এগুলা আসলে আমাদেরই তৈরি। এবং এ থেকে বের হওয়ার ক্ষমতা বা এইগুলা থেকে তৈরি হওয়া কষ্টগুলা কমানোর ক্ষমতা আমদের আয়ত্ত্বের মধ্যেই আছে।

আমাদের এই অর্জনগুলা কিন্তু আরেকটি বার্তা দেয়। সেটি হলো ইতিহাসে শূন্য স্থান থাকে না। যদি দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং যুদ্ধের ঘটনাগুলি কমে যায়, তাহলে আমদের কর্ম তালিকায় অন্য কিছু অবশ্যই বদলে ঢুকে যাবে। তাই আমাদের খুব সতর্কভাবে চিন্তা করা দরকার যে নতুন কর্ম তালিকায় কি কি থাকতে যাচ্ছে। তা না হলে একটি যুদ্ধে জয় লাভ করে, সামনের আরেকটি যুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বসে পড়তে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাহলে এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের কর্মতালিকার শীর্ষে থাকা দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং যুদ্ধের স্থানগুলিতে অন্য কী প্রকল্পগুলি জায়গা করে নেবে?

একটি কেন্দ্রীয় প্রকল্প হবে মানবজাতি এবং পুরো গ্রহকে আমাদের ক্ষমতার অন্তর্নিহিত বিপদ থেকে রক্ষা করা। বুঝিয়ে বলছি। আমারা বিষ্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যম্যে দুর্ভিক্ষ, মহামারি আর যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। এর সরাসরি লাভ হচ্ছে আমাদের হাতে এখন প্রচুর খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি এবং কাঁচামাল এর মজুদ আছে। কিন্তু তা করতে যেয়ে আমরা আবার পৃথিবীর পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছি। যা কেবলমাত্র হালে কিছুটা বুঝতে শুরু করেছি। এখনও পর্যন্ত প্রায় পুরো পৃথিবীর সব দেশই এই পরিবেশগত বিপর্যয়কে নানা ভাবে অস্বীকার করার তালে আছে। উল্টো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, দূষণ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সব রকম প্রমাণ থাকার পরেও, বেশিরভাগ দেশ এখনও পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কোনও গুরুতর অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করেনি। যখন অর্থনৈতিকউন্নতি এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতার মধ্যে কোনটি বেছে নেবার মূহুর্ত আসে, রাজনীতিবিদ, সিইও এবং ভোটাররা প্রায়শই উন্নতিকে অগ্রাধিকার দেয়। একবিংশ শতাব্দীতে, আমরা যদি বিপর্যয় এড়াতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই এর থেকে বের হতে হবে।

তাহলে আমাদের আর অন্য আকাংখাগুলো কি হবে। নিশ্চয়ই আমরা আগের অর্জনগুলাতে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকবো না। যদিও সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকাটাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হতো। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে আমরা সেই পথে হাটবো না। সারা ইতিহাস জুড়ে অল্পে সন্তুষ্ট হওয়া মানুষের নজির নেই। কোন কিছু অর্জন করতে পারলে আমাদের যে প্রতিক্রিয়া হয় সেটা হল আরও কিছু লাভ করা। সামনের দিনগুলাতে আমরা যখন সুপারম্যানের মতই ক্ষমতার অধিকারী হব আর সেই সাথে যখন আমাদের সামনে আগের দিনগুলার মত দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং যুদ্ধের হুমকিগুলো আর থাকবে না, তখন আমরা নিজেদের কি নিয়ে ব্যস্ত রাখবো? বিজ্ঞানীরা, বিনিয়োগকারীরা, ব্যাংকার কিংবা রাষ্ট্রপতিরা সারাদিন কী করবেন? কবিতা লিখবেন?

সাফল্য আরও নতুন কিছু পাবার আকাঙ্খার জন্ম দেয়। তাই আমাদের এই সমসাময়িক অর্জনগুলা, আমাদেরকে আরও দু:সাহসী করতে উৎসাহ দিচ্ছে। আগেকার আর এখনকার রেকর্ড বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য সম্ভবত হবে অমরত্ব, সুখ এবং দেবত্ব (মানে গ্রিক দেবতাদের মত ক্ষমতার অধিকারী) হওয়া। আমরা ক্ষুধা, রোগ এবং সহিংসতার কারণে মৃত্যুহার কমিয়ে এনেছি। এরপর আমরা বার্ধক্য এবং এমনকি মৃত্যুকেও পরাজিত করার লক্ষ্য আগাবো। চরম দারিদ্র্য থেকে মানুষকে রক্ষা করার পর, এখন আমাদের লক্ষ্য থাকবে তারা যেন “আসল” সুখী হয়। আর দৈন্যন্দিন জীবনের সংগ্রাম থেকে মানবজাতিকে উর্ধ্বে তুলে এনে, এখন আমরা মানুষদের দেবতায় রূপান্তরিত করার এবং হোমো স্যাপিয়েন্সকে হোমো ডিউসে পরিণত করার দিকে এগিয়ে যাব।

Tags:

Comments

Leave a Reply