হোমো দিউস: পর্ব ৫.০

মূল: ইউভাল হারারি

অনুবাদ: তাপস

মৃত্যুর মৃত্যু

এই একবিংশ শতকেই, সম্ভবত প্রথমবারের মত আমরা মৃত্যুকে জয় করার জন্য প্রকল্প হাতে নেব। ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত সিরিয়াসলি এ ধরনের কোন কাজে যুক্ত হওয়ার নজির নেই আমাদের। আমরা বৃদ্ধ হই, তারপর মারা যাই। এই চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে আমাদের সেই পুরনো শত্রু; ক্ষুধা আর রোগশোকের বিরুদ্ধে যু্দ্ধ জারি রাখা। একই সাথে এটাও দেখানো যে আমাদের সময়ের সংস্কৃতিতে সবথেকে মূলবান বলে মনে করি যেটা তা হচ্ছে, প্রতিটা প্রাণই গুরুত্বপূর্ণ। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতই কাজকারবার।

মানব জীবন মহাবিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র জিনিস। স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে সংসদের রাজনীতিবিদরা, আদালতের আইনজীবীরা কিংবা থিয়েটারের অভিনেতারা, সবাই এই একই কথাগুলা বলেন। আমাদের সারাক্ষণ মনে করিয়ে দেওয়া হয় এই কথাগুলা। জাতিসংঘের ঘোষণপত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে ‘জীবনের অধিকার’ মানুষের সবচেয়ে মৌলিক অধিকার। যেহেতু মৃত্যু স্পষ্টভাবে এই অধিকারের ভঙ্গ করে, তাই মৃত্যু মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ, আর আমাদের উচিত এর বিরুদ্ধে সর্বাত্বক যুদ্ধ ঘোষণা করা।

মানুষের ইতিহাস যদি একটু ঘেটে দেখেন, তাহলে সেখানে দেখতে পাবেন তখনকার ধর্ম আর বিভিন্ন ধরনের প্রচলতি মতবাদ, এর কোনটাই জীবনকেই পবিত্র বলে মনে করতো না। তারা জীবনের থেকেও অন্য কোন কিছুকে বড় মনে করতো। উল্টো সেই সময়ের ধর্মগুলা যমদূতের বেশ ভক্ত ছিল। এর কারণ হচ্ছে খ্রিস্টান, ইসলাম এবং হিন্দু ধর্ম শেখায় যে, এই জীবনের উদ্দেশ্য, আমাদের মৃত্যুর পর কী ঘটে তার সাথে যুক্ত। তাই তারা মৃত্যুকে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক অংশ হিসেবে দেখেছে। মানুষ মারা যেত কারণ ঈশ্বরের হুকুম ছিল সেরকম তাই। আর তাদের মৃত্যুর মুহূর্তটি এক পবিত্র আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। যখন একজন মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে যায়, সেই সময়টি পুরোহিত, রাব্বি এবং শামানদের ডাকার সময়। জীবনের হিসাব মিটানোর সময় আর মহাবিশ্বে নিজের প্রকৃত ভূমিকার সাথে মিলিত হওয়ার সময়। কল্পনা করার চেষ্টা করুন খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম বা হিন্দুধর্ম, যেখানে মৃত্যুর কোন ব্যাপার স্যাপার নেই। তাহলে তখন সেখানে স্বর্গ, নরক বা পুনর্জন্মহীন এই ব্যাপারগুলাও অর্থহীন হয়ে উঠবে।

মানুষ আসলে কীভাবে মারা যায়? মধ্যযুগের রূপকথায়মৃত্যুকে একটি কালো চাদরে আবৃত ব্যক্তিরূপে চিত্রিত কার হতো। যার হাতে ছিল একটি বড় কাস্তে। একজন মানুষ হাসছে খেলছে, দৌড়াচ্ছে এখানে ওখান। হঠাৎ করে যমদূত তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে কঙ্কালের আঙুল দিয়ে কাঁধে টোকা দিয়ে বলে ‘চল!’ আর সেই মানুষ অনুরোধ করে: ‘না, দয়া করুন! শুধু আর একটা বছর, না না একটা মাস, না হয় একটি দিন অপেক্ষা করুন!’ কিন্তু সেই চাদর ঢাকা শরীর ফিসফিস করে বলে, ‘না! তোমাকে এখনই যেতে হবে!’ এভাবেই আমরা মারা যাই।

কিন্তু বাস্তবে, মানুষ কালো চাদরে মোড়ানো কোনো ব্যক্তির টোকায়, বা ঈশ্বরের নির্দেশে, বা কোনও মহাজাগতিক পরিকল্পনার একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে মারা যায় না। মানুষ সবসময় কোনও প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে মারা যায়। হার্ট রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দেয়। প্রধান ধমনীতে চর্বি জমে। ক্যান্সারের কোষগুলি লিভারে ছড়িয়ে পড়ে। ফুসফুসে জীবাণুগুলি বৃদ্ধি পায়। আর এই সমস্ত প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য দায়ী কী? আরও অন্যান্য প্রযুক্তিগত সমস্যা। হার্ট রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দেয় কারণ হৃদ পেশিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না। ক্যান্সারের কোষগুলি ছড়িয়ে পড়ে কারণ কোনও এক আকস্মিক জিনগত পরিবর্তন তাদের উপর নির্দেশ পাল্টে দেয়। কারও গেইটলক বাসে বসে হাঁচি দেওয়ায় জীবাণুগুলি আমার ফুসফুসে জমে। এর মধ্যে কোনও আধ্যাত্মিকতা নেই। সবই প্রযুক্তিগত সমস্যা।”

আরপ্রতিটি প্রযুক্তিগত সমস্যার একটি প্রযুক্তিগত সমাধান আছে। মৃত্যুকে জয় করতে আমাদেরকে খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ল্যাবে কিছু পাগলা বৈজ্ঞানিকরাই তা করতে পারে। আগে মৃত্যুর ডিপার্টমেণ্ট ছিলো ফাদার আর ধর্মতত্ত্ববিদদের আন্ডারে। এখন ইঞ্জিনিয়াররা সেটার দখল নিয়েছে। আমরা কেমোথেরাপি বা ন্যানো-রোবট দিয়ে ক্যান্সারের কোষ মেরে ফেলতে পারি। আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ফুসফুসের জীবাণু ধ্বংস করতে পারি। যদিহার্ট রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দেয়, আমরা ওষুধ কিংবা বৈদ্যুতিক শক দিয়ে সেটাকে পুনারায় চালু করতে পারি। আর সেটাও কাজ না হলে, আমরা একটি নতুন হার্ট লাগিয়ে নিতে পারি। সত্যি বলতে, এখনো আমাদের কাছে সব প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান নেই। তাই এ কারণেই আমরা ক্যান্সার, জীবাণু, জিনতত্ত্ব আর ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে গবেষণায় এত সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করি।

Tags:

Comments

Leave a Reply