হোমো দিউস: পর্ব ৫.১

ল: ইউভাল হারারি

অনুবাদ: তাপস

তো বলছিলাম যে মৃত্যু একটি টেকনিক্যাল সমস্যা। বিজ্ঞানীদের কথা বাদই দেন। এই আমরা যারা আমজনতা, তারাও মৃত্যুকে এই প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসাবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।যখন আপনার পাশের বাসার ভাবী, তার ডাক্তারের কাছে যায় আর জিজ্ঞাসা করে, ‘ডাক্তার ভাইয়া, আমার কী হয়েছে?’ তখন ডাক্তার সম্ভবত বলবে, ‘আচ্ছা, আপনার ফ্লু হয়েছে অথবা আপনার যক্ষ্মা হয়েছে বা আপনার ক্যান্সার হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার কখনই বলবে না, ভাবী আপনার “মৃত্যু” রোগ হয়েছে। আর আমরা সকলেই জানি এবং মানি যে ফ্লু, যক্ষ্মা এবং ক্যান্সার প্রযুক্তিগত সমস্যা, যার জন্য আমরা হয়তো কোনো একদিন প্রযুক্তিগত সমাধান, যেমন কোন ঔষধ বা ভ্যাকসিন খুঁজে পাব। এমনকি মানুষ যখন ঘূর্ণিঝড় বা গাড়ি দুর্ঘটনা কিংবা যুদ্ধে মারা যায়, সেটিকেও আমরা একটি প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে দেখি। যেগুলা প্রতিরোধ করা যেত এবং উচিত ছিলপ্রতিরোধ করার। যদি সরকার ৫০০ মডেল মসজিদ না বানিয়ে সেই টাকাটা শিক্ষার ক্ষেত্রে ঢালতো কিংবা যদি পৌরসভা সঠিকভাবে তার কাজ করত, কিংবা ধরেন যদি সামরিক কমান্ডার দুরদর্শী সিদ্ধান্তটা নিত, তবে মৃত্যু এড়ানো যেত। ঘটনা এখন এমন হয়ে দাড়িয়েছে, মৃত্যু মানেই মামলা আর তদন্ত। মানে যারা মারা গেল, তারা কীভাবে মারা গেল? নিশ্চয় কোথাও কেউ কোনো ভুল করেছে।

বিজ্ঞানী, চিকিৎসক আর এ সংক্রান্ত যারা জ্ঞানীগুণী, তাদের অধিকাংশই এখনো সরাসরি বলেন না যে মানুষের পক্ষে অমর হওয়া সম্ভব। একটু দূরত্ব রেখে বলেন যে তারা কেবল এই বা সেই বিশেষ সমস্যাটি অতিক্রম করার চেষ্টা করছে। যেমন ধরেন ক্যানসার বা আলঝেইমার কিংবার হার্ট এর কার্যকরিতা ফেরত আনা ইত্যাদিতে গবেষণায় লিপ্ত।

এখানে একটু কিন্তু আছে। লক্ষ্য করুন বার্ধক্য এবং মৃত্যু কোনও বিশেষ সমস্যার ফলাফল ছাড়া আর কিছুই না। তাই ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা গবেষণার কোন পর্যায়ে থেমে গিয়ে ঘোষণা করবে না “যে যথেষ্ট হয়েছে, তারা আর এর বেশী আগাবেন না। তারা স্ক্রীন ক্যানসারের চিকিৎসা বের করছেন। কিন্তু ব্লাড ক্যানসারের চিকিৎসা আর তারা বের করবেন না। মানুষজন ব্লাড ক্যানসারে মারা গেলে তাদের কিছুই যায় আসে না”।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সর্বজনীন ঘোষণায় বলে না যে মানুষের ‘জীবনের অধিকার নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত। সেখানে এককথায় বলা আছে যে প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার রয়েছে আর সেই অধিকার কোন মেয়াদ দ্বারা সীমাবদ্ধ না।

সেই কারণে বিজ্ঞানী এবং চিন্তাবিদদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ এখনকার দিনগুলোতে আরও খোলাখুলিভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করছে এবং বলছে যে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রধান উদ্যোগ হলো মৃত্যুকে পরাজিত করা এবং মানুষকে চিরকালের যৌবন দান করা। উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলেন জেরোন্টোলজিস্ট অউব্রে ডি গ্রে এবং বহুমুখী প্রতিভাবান ও উদ্ভাবক রে কার্জওয়েইল (যিনি ১৯৯৯ সালে মার্কিন জাতীয় প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন পদক পেয়েছিলেন)। ২০১২ সালে কার্জওয়েইলকে গুগলের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ করা হয়, এবং এক বছর পরে গুগল একটি সাব-কম্পানি চালু করে যার নাম ক্যালিকো। এই কোম্পানি কোন লুকাছুপা ছাড়াই ঘোষণা করে তাদের লক্ষ্য ‘মৃত্যুকে সমাধান করা’। সম্প্রতি গুগল আরও এক অমরত্বের সত্যিকার বিশ্বাসী, বিল ম্যারিসকে গুগল ভেঞ্চার্স বিনিয়োগ তহবিলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এক সাক্ষাৎকারে, ম্যারিস বলেছিলেন, ‘আপনি যদি আজ আমাকে প্রশ্ন করেন, ৫০০ বছর বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা, তবে আমার উত্তরটি হবে হ্যাঁ।’ ম্যারিস শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত দেননি। বরং বিশাল বিনিয়োগ করে দেখিয়েছেন, তিনি যা বলেন সেটাতে বিশ্বাসও করেন। গুগল ভেঞ্চার্স, এর ২০০ কোটি ডলার এর মূলধনের ৩৬ শতাংশ জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত স্টার্ট-আপে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হচ্ছে জীবনের আয়ু বাড়ানো সংক্রান্ত। ম্যারিস এর বক্তব্যকে আমাদের ক্রিকেটকের ভাষায় ব্যাখ্যা করলে যা দাড়ায় সেটা হচ্ছে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা সন্মানজনক পরাজয় চাইছি না। আমরা পুরো সিরিজ জিততে চাইছি। কেন? কারণ, ম্যারিস বলেন, “জীবন, মৃত্যূর থেকে উৎকৃষ্ট “।

সিলিকন ভ্যালির অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এমন স্বপ্নের অংশীদার। পেপ্যালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েল সম্প্রতি স্বীকার করেছেন যে তিনি চিরকাল বাঁচতে চান। তার মতে মৃত্যুর প্রতি আমাদের তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত আপনিমৃত্যুকে মেনে নিতে পারেন। দ্বিতীয়তত, আপনি এটিকে অস্বীকার করতে পারেন। তৃতীয়তত, আপনি এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন। পিটার থিয়েল আরও বলেন যে তিনি মনে করেন যে আমাদের সমাজ চলছে যারা অস্বীকার বা মেনে নেয় এমন সংখ্যাগুরু লোকজন দিয়ে আর তিনি সেটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পছন্দ করেন। অনেকেই হয়তো এমন বক্তব্যকে ফালতু স্বপ্ন হিসেবে উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু থিয়েল আমাদের হিরো আলম টাইপের কেউ না। তিনি সিলিকন ভ্যালির অন্যতম সফল এবং প্রভাবশালী উদ্যোক্তা, যার ব্যক্তিগত সম্পদ প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, রিজেনারেটিভ চিকিৎসা এবং ন্যানোপ্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রগুলোর অবিশ্বাস্য উন্নতি আমাদেরকে আরও বেশি আশাবাদী করে । কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে মানুষ ২২০০ সালের মধ্যে মৃত্যুকে অতিক্রম করবে, অন্যদের মতে ২১০০ সালের মধ্যে। কার্জওয়েইল এবং ডি গ্রে আরও আশাবাদী। তারা বিশ্বাস করেন যে ২০৫০ সালে যাদের একটি সুস্থ শরীর এবং একটি সুস্থ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকবে, তারা প্রতি দশকে মৃত্যুকে প্রতারণা করে অমরত্বের একটি বড় সুযোগ পাবে। কার্জওয়েইল এবং ডি গ্রের মতে, প্রতি দশ বছর বা তার কাছাকাছি আমরা ক্লিনিকে গিয়ে শরীর পুনঃগঠনের চিকিৎসা নেব। সেটা কেবল অসুস্থতা নিরাময় করবে না, বরং ক্ষয়প্রাপ্ত টিস্যু পুনরুজ্জীবিত করবে এবং হাত, চোখ এবং মস্তিষ্ককে আপগ্রেড করবে। পরবর্তী চিকিৎসা হওয়ার আগেই ডাক্তাররা অনেক নতুন ওষুধ, আপগ্রেড এবং গ্যাজেট আবিষ্কার করবেন। যদি কার্জওয়েইল এবং ডি গ্রে সঠিক হন, তবে আপনার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে ইতিমধ্যেই হয়তো কিছু অমর লোকজন হাঁটাচলা করছে, অবশ্য আপনার বাড়ি যদি গুলশান কিংবা বারীধারার মত জায়গায় হয় তাহলেই হয়তো তাদের দেখতে পাবেন।

Tags:

Comments

Leave a Reply