হোমো দিউস: পর্ব ১

মূল: ইউভাল হারারি
অনুবাদ: তাপস

তৃতীয় সহস্রাব্দের কোন এক সময়ে আমাদের চাওয়া পাওয়ার ধরণগুলো কি ধরনের হবে? এর উত্তর দেবার আগে আমরা দেখে নেই গত কয়েক হাজার বছর ধরে আমাদের চাহিদাগুলো কি ছিলো। সেই অনাগত সময় থেকে এই সেইদিন পর্যন্ত আমাদের চাহিদাগুলা প্রায় একই ছিল। বিশ শতকের চায়নার, কিংবা মধ্য যুগের ভারত থেকে শুরু করে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায়, সেই একই সমস্যাগুলা ঘুরে ফিরে লিষ্টের উপরের দিকে থাকতো; মঙ্গা, মহামারী এবং যুদ্ধ এবং সেগুলা থেকে মুক্তি!

যুগের পর যুগ ধরে, কোটি কোটি মানুষ, হাজারো দেবদেবী বা সাধু সাধ্বীদের কাছে প্রার্থনা করেছে। অসংখ্য নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করছে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং নিয়মকানুন তৈরি করছে। কিন্তু যেই লাউ সেই কদুই রয়ে গেছে। কাতারে কাতারে মানুষ মারা গেছে সেই যুদ্ধ, মহামারী আর খাদ্যাভাবে। সেইজন্যে অনেক দার্শনিক এবং জ্ঞানীগুণী জন বলেই দিয়েছেন যে এই সমস্যগুলার কোন সমাধান আগেও ছিলো না এমনকি ভবিষ্যৎতেও থাকবে না! এগুলো নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে! এটাই আমাদের নিয়তি।

অথচ তৃতীয় সহস্রাব্দের সূচনালগ্নে আমারা দেখবো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক চমক! আসলে উপরের বর্ণিত সমস্যাগুলা গত কয়েক যুগে আমরা ইতিমধ্যে সমাধান করে ফেলেছি! শতভাগ না হলেও কাছাকাছি পৌঁছুতে পেরেছি। এমন না যে এখন আর না খেতে পেয়ে কোন লোক মারা যায় না। তা সত্তেও । আসলে আমরা এখন এই দু:র্ভিক্ষ বলেন কিংবা মহামারীই বলেন, এইগুলার কারণ এবং তার প্রতিকার কি সেটা বের করে ফেলেছি। আগের দিনের মত এগুলো সব উপর ওয়ালার ইচ্ছা বলে চালিয়ে দেয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন কোথাও যুদ্ধ, দু:র্ভিক্ষ কিংবা মহামারী দেখা দিলে হা হুতাশ বা আহাজারী করেই সরে পড়ি না। বরং জানি যে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন মানুষের হাত আছে। আরও স্পষ্ট করে বললে কোন নির্দষ্ট কারও অবহেলার জন্যই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। যেমন সম্প্রতি ইয়েমেনের দু:ভিক্ষের জন্য সৌদি প্রসাশকগণ সরাসরি দায়ী, কিংবা কোভিড মহামারীর জন্য চায়নার হেলথ মিনিষ্ট্রির গুরুত্ব না দেওয়া ইত্যাদি। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আমরা এর কারণ খুজে বের করেই শান্ত হই না, ভবিষ্যৎতে যেন এই ধরনের ঘটনা আর ঘটে, সে ব্যাপারেও ব্যাবস্থা নেই। সে কারণেই এই ধরনের বড় ধরনের ঘটনাগুলা আস্তে আস্তে কমে এসেছে।

ইতিহাসে প্রথমবারের মত এখন বেশী লোক মারা যাচ্ছে অতিরিক্ত খাবার গ্রহনের জন্য। না খেতে পাবার জন্য না। কিংবা ধরেন এখনকার দিনে বৃদ্ধ বয়সে মারা যাওয়ার লোকের সংখ্যা, মহামারীতে মারা যাওয়াদের থেকে অনেক অনেক বেশি। কিংবা আরও ধরেন সারা পৃথিবীতে যত লোক আত্যহত্যা করে মারা যায়, যুদ্ধের সৈনিকদের হাতে, সন্ত্রাসী আর অপরাধীদের হাতে মারা যাওয়াদের সংখ্যা এক করলেও তা অতি নগন্য। এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, আপনার মিকডোনাল্ডের বিগ ম্যাক খেয়ে পটল তোলার সম্ভাবনা, অনাবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট দু:ভিক্ষে বা ইবোলা ভাইরাসের আক্রমণে কিংবা আ-ল কা-য়ে-দার হাতে মারা পড়ার থেকে সহস্রগুণ বেশি!

সেজন্যই, এখনকার রাষ্ট্রনায়ক বা জেনারেলদের কর্মতালিকায় অর্থনৈতিক দুর্যোগ বা যুদ্ধ বিগ্রহ উপরের দিকে থাকলেও, আমরা যদি দূর ভবিষ্যৎতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো তাহলে দেখতে পাবো ভিন্ন চিত্র। আমরা যদি সত্যি সত্যি এই দু:র্ভিক্ষ, মহামারী আর যুদ্ধ বন্ধ করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যৎতে আমাদের দু:শ্চিন্তার তালিকায় উপরের দিকে কি কি থাকবে? তুলনা করার জন্য কল্পনা করতে পারেন এমন এক জায়গার কথা যেখানে কখনও আগুন লাগবে না, সেখানকার অগ্নীনির্বাপক কর্মিদের কথা!

তাই সময় এসেছে আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করার: আমরা এই আমাদেরকে নিয়ে কি করবো? ভবিষ্যৎতের চির শান্তির, সুখী আর সমৃদ্ধির পৃথিবীতে, কি বা কোন বিষয়গুলা আমাদেরকে ব্যস্ত রাখবে? এই প্রশ্নটা আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হালের বায়োটেকনলজি আর তথ্য বিজ্ঞান যে কল্পানতীত ক্ষমতা আমাদের দিতে যাচ্ছে। সেই অতিমানবিক ক্ষমতা দিয়ে আমরা তখন কি করবো?

Senzen

Tags:

Comments

Leave a Reply